ধারাবাহিক মূল্যায়নের পদ্ধতি হলো শ্রেণীশিক্ষক প্রতিমাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতির মূল্যায়ন রেকর্ড করবেন। প্রতি চার মাস পর রিপোর্ট কার্ড প্রদান করবেন, যাতে অভিভাবকরা তা দেখে সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। |
আগামী বছর থেকে থাকছে না প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা। শিশুদের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য এবং শিক্ষা থেক শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২১) থেকেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে।
পরীক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে শিশুদের শিক্ষার সার্বিক দিক বিবেচনা করে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হবে। সরকার নতুন শিক্ষাক্রমসহ আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী বছর থেকেই কার্যকরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানায়, ইতোমধ্যেই পাইলট হিসেবে ১০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষার পরিবর্তে ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ বিবেচনায় নিয়ে উদ্যোগ কার্যকর করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১০০ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ শতভাগ সফল বলেই মনে করছেন কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তাদের সূত্রে আরো জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) তুলে দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন দেশের শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। কোমলমতি শিশুদের ওপর পরীক্ষার সময় যে চাপ তৈরি হয়, সেটি বিভীষিকা উল্লেখ করেও শিশুদের কৈশোরের আনন্দ ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানিয়ে আসছেন তারা। বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সমাপনী পরীক্ষার কথা না বললেও গত বছর ১৩ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিশুদের ওপর থেকে চাপ কমানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন – অনেক সময় দেখা যায় প্রতিযোগিতা শিশুদের মধ্যে না হয়ে অভিভাবকদের মধ্যে বেশি হচ্ছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। অভিভাবকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার এ ব্যাধি শিশুর মধ্যে কেবল শেখার প্রতি অনীহাই তৈরি করে না; একই সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে এবং অতিমাত্রায় খবরদারির কারণে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলে শিশুরা। ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিশুদের পরীক্ষা না থাকার উদাহরণ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
মূলত প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশের পর থেকেই নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও এনসিটিবি। তবে কিভাবে কার্যকর করা হবে তা নিয়ে কিছুৃটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন কর্মকর্তারা। এর মধ্যেই গত বছর ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বিকল্প ভাবতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন – পরীক্ষার নামে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিতে দিতে বাচ্চারা ক্লান্ত। পরীক্ষা কোমলমতি বাচ্চাদের শেষ করে দিচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প কিছু বের করতে হবে। এ সময় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশের কথাও কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ চলতি বছর থেকেই কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল গত বছর ডিসেম্বরে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই ঘোষণা কার্যকরের দিকে নজরও ছিল কোটি কোটি শিশু ও অভিভাবকের। কিভাবে কার্যকর হবে তা নিয়ে নানা মহলের প্রস্তাবও আসে। কিন্তু চলতি বছর থেকে সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। তবে আগামী বছর থেকেই উদ্যোগ কার্যকরের সকল কাজ প্রায় শেষ বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
কিভাবে শিশুরা এক শ্রেণী থেকে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে তাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। কোন লিখিত পরীক্ষা বা প্রচলিত পরীক্ষা থাকবে না। ক্লাসে উপস্থিতি থেকে শুরু করে শিশুর শিক্ষার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করব। পরীক্ষার পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার অগ্রগতি যাচাই করা হবে।
ধারাবাহিক মূল্যায়নের পদ্ধতি হলো শ্রেণীশিক্ষক প্রতিমাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতির মূল্যায়ন রেকর্ড করবেন। প্রতি চার মাস পর রিপোর্ট কার্ড প্রদান করবেন, যাতে অভিভাবকরা তা দেখে সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।
শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতির জন্য গ্রেডিং পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক অর্থাৎ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শোনা, বলা, পড়া, কর্মদক্ষতা ও বিষয় জ্ঞান দেখা হবে। ব্যক্তিগত গুণাবলী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার এবং বিশেষ পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হবে।
বর্তমানে যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয় তা হলো সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতি। নির্দিষ্ট সময় শেষে এই মূল্যায়ন হয়। আগামী বছর থেকে সেটা ধারাবাহিক মূল্যায়নে যাবে। বছরে তিনটি মূল্যায়নের সমন্বয় করে শিশু পরবর্তী শ্রেণীতে পদোন্নতি পাবে।
বাংলা ও ইংরেজী বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শোনা, বলা, পড়া ও লেখা এ চারটি বিষয় মূল্যায়ন করা হবে। বিভিন্ন রকম ধ্বনি ও শব্দ শুনে আলাদা করতে পারা, শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে বলার পারঙ্গমতা দেখা হবে। স্পষ্ট ও সঠিক আকৃতিতে লিখতে পারা এবং পড়ার ক্ষেত্রে উচ্চারণ, সাবলীলতা, শুদ্ধতা, শ্রবণযোগ্যতা যাচাই করে মূল্যায়ন করা হবে।
গণিত বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন কাঠামোতে গাণিতিক প্রক্রিয়া (যোগ, বিয়োগ, গুণ বা ভাগ) কেন ব্যবহার করতে হয় তা বুঝতে পারা। ভিন্ন ভিন্ন গাণিতিক প্রক্রিয়া ব্যবহারের কৌশল জানা ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা বুঝতে পারা দেখা হবে। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের সমাজ ও পরিবেশ বিষয়ে জানা, অনুধাবন, প্রয়োগ করে দেখা হবে। প্রাথমিক বিজ্ঞান মূল্যায়নে কোন বিশেষ তথ্য বা অভিজ্ঞতা স্মরণ করার মানসিক ক্ষমতা দেখা হবে। এছাড়া শিক্ষক কাগজ-কলমে বা লেখা বা চিত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখাবেন।
চলতি বছর এই পদ্ধতি চালু করার কথা থাকলেও ২০২১ সালে নতুন কারিকুলামের সাথেই এই পদ্ধতিটি চালু করা হবে। ফিনল্যান্ডের মত বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির(নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামূল কবীর বলেন – প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নিয়েও ভাবা জরুরী। কারণ এ পরীক্ষা যেভাবে হচ্ছে তাও শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ তৈরি করছে।
তিনি আরো বলেন – এ পরীক্ষার পরিবর্তে সর্বোচ্চ হলে উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। তিনি আর বলেন, এখানে গ্রেডিং সিস্টেমটাও পাল্টাতে হবে। এভাবে করার কোন দরকার নেই। একটা পরীক্ষা হবে তার ভিত্তিতে বৃত্তি। এখানে গ্রেডিংয়ের মতো মূল্যায়ন এনে শিশুর ওপর চাপ দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা দেবে সকলকে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করতে হবে। আর বৃত্তির নিয়ম অনুসারে যারা পাওয়ার কথা তাদের বৃত্তি দেয়া হবে। এটা হলে শিশুদের ওপর এত বড় একটা পরীক্ষার চাপ কমবে।
দিনের ব্রেকিং নিউজ সবার আগে পেতে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন:
সরকারি এবং বেসরকারি চাকুরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেতে
পাঠকের মতামত